কে বলবে তাঁর বয়স ৬০ পেরিয়েছে! কখনো বিমানের চাকা ধরে ঝুলছেন, কখনো মোটরসাইকেল নিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছেন পাহাড় থেকে। মিশন ইম্পসিবল নিয়ে আবারও পর্দায় হাজির টম ক্রুজ। ছোটবেলা থেকে কীভাবে নিজেকে চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করেছেন হলিউডের এই অভিনেতা? ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে হাজির হয়ে সেসব কথাই বলেছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।
বয়স কত আর হবে, বড়জোর তিন। কখনো কখনো এমন হতো—খোলা জানালা দিয়ে চুপিচুপি হামাগুড়ি দিয়ে ছাদে চলে যেতাম। শুধু তারা দেখব বলে। দেখা যেত, প্রতিবেশীরা কেউ না কেউ মা-বাবাকে ফোন করে বলত, ‘তোমাদের ছাদে একটা বাচ্চাকে দেখলাম মনে হলো!’
অনেক সময় গাছ বেয়ে উঠে যেতাম। সবই আমার কাছে রোমাঞ্চকর ছিল। জীবনকে, মানুষকে বুঝতে চাইতাম।
অভিনেতা হওয়ার সিদ্ধান্ত যখন নিই, তখন আমার বয়স চার বছর। ইচ্ছা ছিল সারা পৃথিবী ঘুরব। দুনিয়ার আনাচকানাচের মানুষ আর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হব। জেট বিমানে চড়ব, প্যারাস্যুট নিয়ে বিমান থেকে লাফ দেব। আমার ধারণা, চার বছর বয়সে এ ধরনের স্বপ্ন সবাই–ই দেখে। কিন্তু আমি এসব সত্যিই মন থেকে চেয়েছিলাম। তাই নিজের লক্ষ্যগুলো লিখে রাখতাম। এমনকি মানুষকে বলতাম।
শুনে সবাই বলত, ‘বাচ্চা ছেলে, এসব কি কখনো হয়!’ তাই একসময় মানুষকে বলা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু মনে মনে ওই সব স্বপ্নই আমার নানা সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হতো।
শুরুর দিকে চলচ্চিত্রে একটা-দুটো সংলাপ পেতাম। একসময় দেখলাম, ‘তৃতীয়-মূল চরিত্রের’ (থার্ড লিড) প্রস্তাবও পাচ্ছি। সে সময় বিছানায় শুয়ে ভাবতাম, আমি তো কখনো ফিল্ম স্কুলে যাইনি। অভিনয়ের ক্লাস করিনি। যা কিছু শিখেছি, সবই সিনেমা দেখে, সিনেমার পর্যালোচনা করে।
মনে আছে, সেটে গেলে মনে হতো এই সুযোগ তো জীবনে আর না-ও আসতে পারে। তাই একে একে ফিল্ম ক্রুদের প্রত্যেকের কাছে যেতাম, হাজারটা প্রশ্ন করে জ্বালিয়ে মারতাম। সিনেমাটোগ্রাফার ওয়েন রোয়েজম্যান, প্রযোজক স্ট্যানলি জেফ, পরিচালক হ্যারল্ড বেকার, কাউকে ছাড়িনি। এভাবে ঘুরঘুর করতে করতেই এক রোববার সকালে আবিষ্কার করলাম, (অভিনেতা) জর্জ সি স্কটের সঙ্গে বসে দাবা খেলছি।
এমন নয় যে স্রেফ তাঁদের আশপাশে থাকতে চেয়েছি। বরং সত্যিই আমার খুব শেখার আগ্রহ ছিল। ক্রমাগত প্রশ্ন করতাম। সিনেমা নিয়ে পড়তাম। অভিনেতা, সিনেমাটোগ্রাফার, পরিচালক, সবাইকে নিয়ে পড়তাম। আর যখন তাঁদের কারও সঙ্গে দেখা হতো, সিনেমা ধরে ধরে নানা কিছু জানতে চাইতাম।
এটা আসলে আমার মধ্যে সহজাত ছিল। তখন বুঝিনি, এই কৌতূহলই আমাকে একটু একটু করে গড়ে তুলছে।
মনে আছে ট্যাপস–এর (১৯৮১) শুটিংয়ের সময় একদিন হোটেলে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলাম। চেষ্টা করছিলাম সব খুঁটিনাটি মনে রাখতে, সব আত্মস্থ করতে। একসময় হেসে ফেললাম। মনে হলো, এটা তো পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। সব তো মাথার ভেতর নেওয়া সম্ভব নয়। আমি তো জানিই না, আমি কী জানি না এবং এতে দোষের কিছু নেই।
অতএব ঠিক করলাম, অভিনয়টা আমি হৃদয়ে ধারণ করব। অভিনয়ে বাঁচব, কাজটা উপভোগ করব। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলাম, প্রতিটা দিন নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব; যতখানি পারি। যা আমি ভালোবাসি, তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারাটা বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
কখনো কখনো মনে হয়, ফিল্ম স্কুলে না গিয়ে ভালোই করেছি। কেউ আমাকে বলে দেয়নি, ‘এভাবে করো।’ বরং নিজে নিজে আবিষ্কার করেছি। নিজেই নিজের ফিল্ম স্কুল বানিয়ে নিয়েছি। সিনেমাকে ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছি। কখনো সম্পাদকের চোখে। কখনো পরিচালকের, কখনো দর্শকের, কখনো শিল্পীর চোখে। নিজের কাজটা অন্যের চোখে দেখে আমি নিজেকে মূল্যায়ন করেছি।
এ জন্যই সিনেমা এক ভালোবাসার নাম। এটা একটা সম্মিলিত অনুভূতি দেয়। আলাদা আলাদা গল্প, আলাদা আলাদা জীবন সঙ্গে নিয়ে আমরা থিয়েটারে হাজির হই ঠিকই, কিন্তু একসঙ্গে একটা সিনেমা দেখার অনুভূতি ভাগাভাগি করে নিই।
শুধু সিনেমা নয়, স্টুডিও সিস্টেম, সিনেমার পরিবেশনা, সব আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি। যখন তরুণ ছিলাম, স্টুডিওগুলোকে অনুরোধ করতাম। বলতাম, আমাকে বিভিন্ন দেশে পাঠান। আমার খুব সৌভাগ্য, বিভিন্ন দেশে সিনেমার বিপণন দলের সঙ্গেও কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ভাবুন তো, ২০ বছরের এক তরুণ, মার্কেটিংয়ের লোকজনের মাঝখানে বসে আছে। তারাও যে আমাকে গ্রহণ করতে খুব একটা রাজি ছিল, তা নয়। বরং তাদের দৃষ্টি বলে দিত, ‘এই বাচ্চা ছেলেটা আবার কে?’
আমি সোজাসাপটা বলতাম, ‘দেখো, আমি শুধু শিখতে চাই।’ ধীরে ধীরে তারা আমার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।
দেশে দেশে ঘুরেছি। নানা মানুষের সঙ্গে নিজের ছবি দেখেছি। বইয়ে পড়ে নয়, আমি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিখেছি। সেই সময় হলিউড খুবই আমেরিকাকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু আমি সারা বিশ্বের দর্শককে নিয়ে ভেবেছি। তাদের কাছেও পৌঁছতে চেয়েছি।
একসময় মাথায় একটা আইডিয়া এল, হলিউডের মতো বিশ্বের আরও নানা শহরেও লালগালিচা বিছিয়ে ছবির প্রিমিয়ার করলে কেমন হয়? শুরু হলো আন্তর্জাতিক প্রিমিয়ারে অংশ নেওয়া। একেক দিন একেক দেশে হাজির হতাম, ছবি দেখতাম, সময় কাটাতাম। এসবই কিন্তু ইন্টারনেট আসার বহু আগের কথা। আজকের দিনের অনেক দর্শকের তখনো জন্মও হয়নি!
ভাবতে পারেন? সেই সময়ে আগস্ট মাসে আমরা ইউরোপে কোনো ছবি মুক্তি দিতাম না। কারণ, সেখানকার প্রেক্ষাগৃহে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছিল না! তখন আমিই বললাম, চলো, আমরা থিয়েটারে কিছু এসি লাগাই। তবেই তো আমাদের ছবি আরও কয়েক সপ্তাহ চলবে।
এভাবেই সিনেমার নানা অংশের সঙ্গে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়েছি। তবে সব সময় ফিরে গেছি গল্পের কাছে। (ঈষৎ পরিমার্জিত)